চলতি বছর শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন দুই সাংবাদিক। তারা হলেন- ৫৮ বছর বয়সী মারিয়া রেসা ফিলিপিনো বংশোদ্ভূত আমেরিকান। ৫৯ বছর বয়স্ক দিমিত্রি মুরাতভ রাশিয়ার সাংবাদিক।
নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘গণতন্ত্র ও শান্তির অন্যতম শর্ত মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সুরক্ষায় ভূমিকা রাখায়’ দুজনকে নির্বাচিত করা হয়েছে।
কমিটির পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, ‘যে বিশ্বে ক্রমশ গণতন্ত্র ও সংবামাধ্যমের স্বাধীনতা প্রতিকূল পরিবেশের সম্মুখীন হচ্ছে, সেখানে শান্তিতে নোবেলজয়ী মারিয়া রেসা ও দিমিত্রি মুরাতভ সেসব সাংবাদিকের প্রতিনিধি, যারা আদর্শের জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন।’
রাশিয়া ও ফিলিপাইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে সাহসী লড়াইয়ের জন্য মারিয়া রেসা ও দিমিত্রি মুরাতভ এ বছর পুরস্কার পেলেন।
২০১২ সালে ডিজিটাল মিডিয়া কোম্পানি র্যাপলার ডটকম প্রতিষ্ঠা করেন মারিয়া রেসা। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে কাজে লাগিয়ে নিজ দেশ ফিলিপাইনে ক্ষমতার অপব্যবহার, পেশিশক্তির অপপ্রয়োগ ও ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদকে তুলে ধরেছেন তিনি।
BREAKING NEWS:
The Norwegian Nobel Committee has decided to award the 2021 Nobel Peace Prize to Maria Ressa and Dmitry Muratov for their efforts to safeguard freedom of expression, which is a precondition for democracy and lasting peace.#NobelPrize #NobelPeacePrize pic.twitter.com/KHeGG9YOTT— The Nobel Prize (@NobelPrize) October 8, 2021
সাংবাদিক ও র্যাপলারের প্রধান নির্বাহী হিসেবে মারিয়া রেসা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে আপসহীন সৈনিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। দুতার্তের শাসনামলে বিতর্কিত ও প্রাণসংহারী মাদকবিরোধী অভিযানের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখে র্যাপলার।
শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী আরেক সাংবাদিক দিমিত্রি মুরাতভ কয়েক দশক ধরে রাশিয়ায় অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই করে চলেছেন। ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন সংবাদপত্র নোভায়া গেজেটার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুরাতভ।
চলমান হত্যাযজ্ঞ ও হুমকি পাওয়ার পরও নোভায়া গেজেটার প্রধান সম্পাদক মুরাতভ নিজের পত্রিকার স্বাধীন ভূমিকাকে খর্ব করতে রাজি হননি। প্রতিনিয়ত তিনি সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার থেকেছেন।
নোভায়া গেজেটার তথ্যভিত্তিক সাংবাদিকতা ও পেশাগত সততার মাধ্যমে রুশ সমাজের অপ্রীতিকর দিকগুলো তুলে ধরেছে। এ বিষয়গুলো মূলধারার অন্য সংবাদমাধ্যমগুলোতে খুব একটা আসেনি। যাত্রা শুরুর পর থেকে পত্রিকাটির ছয়জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯০১ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী শান্তিপ্রতিষ্ঠায় অবদান রাখা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। মাঝে বিশ্বযুদ্ধের বছরগুলোতে পুরস্কার দেয়া বন্ধ ছিল। ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট ১০১ বার শান্তিতে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। আর এ পুরস্কার জিতে নিয়েছেন ১৩৫ বিজয়ী, যাদের মধ্যে রয়েছেন ১০৭ জন ব্যক্তি ও ২৮টি প্রতিষ্ঠান।
এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি তিনবার শান্তিতে নোবেল পেয়েছে রেড ক্রস (১৯১৭, ১৯৪৪ ও ১৯৬৩ সালে)। এছাড়া জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর পেয়েছে দুবার (১৯৫৪ ও ১৯৮১ সালে)।
গত বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জিতেছে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বা ডব্লিউএফপি। ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই, যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলগুলোতে পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং ক্ষুধাকে যুদ্ধ-সহিংসতার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার বন্ধের চালিকাশক্তি হিসেবে অবদান রাখায় সম্মানজনক এ পুরস্কার দেওয়া হয় জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থাটিতে।
এর আগের বছর, অর্থাৎ ২০১৯ সালে শান্তিতে নোবেল জেতেন ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ। প্রতিবেশী ইরিত্রিয়ার সঙ্গে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব ও দেশটির মধ্যে জাতিগত সংঘাত নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় এ পুরস্কার পান তিনি।
এর আগে নেলসন ম্যান্ডেলা, মাদার তেরেসা ও বারাক ওবামার মতো ব্যক্তিত্বরা নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন।
এক নজরে শান্তিতে নোবেলজয়ী দুই সাংবাদিক
মানবাধিকার প্রশ্নে আপসহীন সাংবাদিক মারিয়া রেসা ও দিমিত্রি মুরাতভ। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় দীর্ঘদিন কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ফিলিপাইন ও রাশিয়ার এ দুই সাংবাদিক পেয়েছেন এ বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার। দীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েছেন তারা।
এখনও কাজ করে যাচ্ছেন মানুষের কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠায়। শান্তিতে তাদের নোবেল পুরস্কার অর্জন প্রেরণা যোগাবে বিশ্বজুড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কর্মরত সাংবাদিকদেরও।
এখন বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রেসা ও মুরাতভই। শুক্রবার (৮ অক্টোবর) বিকেলে নরওয়ের রাজধানী অসলোতে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নোবেল কমিটি বিজয়ী দুজনের নাম ঘোষণার পর তাদের পরিচয় কী, তারা কী ভূমিকা রেখেছেন মতপ্রকাশের স্বাধীনতায়, এমন নানান প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন সবাই।
সাহসী মারিয়া রেসা
র্যাপলার ও নোবেল কমিটির তথ্য মতে, সাংবাদিকতায় ৩৫ বছর পার করেছেন এশিয়ার গর্ব মারিয়া রেসা। মাতৃভূমি ফিলিপাইনের মানুষের মতপ্রকাশের ব্যাপারে সব সময় সোচ্চার তিনি। দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে র্যাপলার। তবে কাজ করতে গিয়ে সব সময় তিনি ফিলিপাইন সরকারের রোষানলে পড়েন। প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুর্তেতের সরকার তাকে আটকও করে। যদিও পরে ছাড়া পান রেসা।
তিনি সাহসী পদক্ষেপ এবং ভূমিকার জন্য ২০১৮ সালে টাইম ম্যাগাজিনের ‘পারসন অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালে টাইম ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে ‘শতাব্দীর সেরা প্রভাবক মানুষ’ হিসেবে স্বীকৃতি পান। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির শত উৎসাহদাতার তালিকায়ও উঠে আসে তার নাম। ২০২০ সালে তিনি ‘জার্নালিস্ট অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করায় তিনি জিতে নেন গোল্ডেন পেন ফ্রিডম অ্যাওয়ার্ড। এছাড়াও সাংবাদিকতার বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন রেসা।
র্যাপলার প্রতিষ্ঠা করার আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রেসা পর্যটনকেন্দ্রিক অনুসন্ধানী কাজের ওপর জোর দেন। ১৯৯৫ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিনি জাকার্তা ব্যুরো খোলার আগে প্রায় এক দশক সিএনএন এর ম্যানিলা ব্যুরোয় কাজ করেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে নিয়ে তিনি লিখেন ‘সিডস অব টেরর’ নামে বই, যেখানে আল কায়েদা ও ওসামা বিন লাদেন সম্পর্কিত তথ্যও উঠে আসে।
লড়াকু দিমিত্রি মুরাতভ
‘নভায়া গাজেতা’ ও নোবেল কমিটির তথ্যানুসারে, রাশিয়ার পত্রিকা ‘নভায়া গেজেতা’র প্রধান সম্পাদক দিমিত্রি মুরাতভ শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও পরিচিত মুখ। ৫৯ বছর বয়সী মুরাতভ কখনো সত্যের পথ থেকে পিছপা হটেননি।
রাশিয়ায় সমালোচকদের অনেককেই ‘ফরেন এজেন্ট’ বলে অভিযুক্ত করা হয়। স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতা করা দেশটিতে খুবই কঠিন ব্যাপার। এই প্রতিকূলতার মধ্যেই মুরাতভ কয়েক দশক ধরে রাশিয়ায় স্বাধীন সাংবাদিকতা চালিয়ে যাচ্ছেন।
মুরাতভ ১৯৯৩ সাল থেকে কর্মরত ‘নভায়া গেজেতা’র পুরো টিমকে এই পুরস্কার উৎসর্গ করেছেন। বিশেষ করে পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে যে ছয়জন সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের স্মরণ করেছেন তিনি।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর তিনিই প্রথম রাশিয়ান, যিনি শান্তিতে নোবেল পেলেন। এর আগে ১৯৯০ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ এ পুরস্কার পান। তার আগে ১৯৭৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের নাগরিক হিসেবে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান পদার্থবিদ, মানবাধিকারকর্মী আন্দ্রেই শাখারভ।